স্মার্টফোনের কোন লকটি (ফেস, ফিঙ্গারপ্রিন্ট, পাসওয়ার্ড, পিন) সবচেয়ে বেশি নিরাপদ?

প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে স্মার্টফোন গুলো একটু বেশিই স্মার্ট হয়ে গিয়েছে। এখন ফোন মুখের সামনে ধরলে আনলক হয়ে যায়। ফেস, ফিঙ্গারপ্রিন্ট, পাসওয়ার্ড, পিন ইত্যাদি নানাভাবে স্মার্টফোন ব্যবহারকারীরা তাদের ফোন লক আনলক করতে পারেন। কিন্তু এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, এতগুলো অপশনে মধ্যে কোনটি বেশি উপযোগী বা কোনটি বেশি নিরাপদ? এবং আপনি কোনটি ব্যবহার করেন। এসব প্রশ্নের উত্তর নিয়ে আমাদের আজকের পোস্ট এবং সঠিক উত্তরটি জানতে হলে আর্টিকেলটি শেষ পর্যন্ত পড়তে হবে।
১. ফেস আনলক:
ফেস আনলক বা ফেস রিকগনিশন সিস্টেম কিন্তু নতুন কিছু নয়। অ্যান্ড্রয়েডে অনেক পূর্বে থেকেই এই ফিচারটি ছিল। তবে পূর্বের ফেস লক থেকে বর্তমান ফেস লক সিস্টেম কিছুটা সিকিউর! “আমি কেন “কিছুটা” লিখলাম?” — কেননা এটি ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও পিন লেভেলের সিকিউর নয়। পূর্বের টেকে ক্যামেরা দিয়ে ফেসের ছবি উঠানো হতো, তারপরে ফেসের সাথে মিল করে ফোন আনলক করা হতো। একে তো অন্ধকারে ফেস আনলক খুব খারাপ কাজ করতো, কখনো করতোই না। আবার ছবি দেখিয়েও এসকল ফেস লক আরামে খুলে ফেলা যেতো।
অ্যাপেল তাদের আইফোন এক্স এর সাথে যে ফেস রিকগনিশন সিস্টেম দিয়েছে, যেটার নাম রাখা হয় ফেস আইডি, সেটা এক আলাদা পদ্ধতিতে কাজ করে। এতে শুধু ক্যামেরা হয় নানান টাইপের সেন্সর ইউজ করা হয়, তারপরে ফেসের 3D মডেল তৈরি করে, সিস্টেম নিজে নিজেই অনেক শিক্ষা লাভ করে, তারপরে সেই অনুসারে কাজ করে।
টেকনো ইনফো বিডি'র প্রিয় পাঠক: প্রযুক্তি, ব্যাংকিং ও চাকরির গুরুত্বপূর্ণ খবরের আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ টেকনো ইনফো বিডি এবং টেলিগ্রাম চ্যানেল এ লাইক দিয়ে আমাদের সাথেই থাকুন। |
মিড বাজেট থেকে শুরু করে হাই এন্ড পর্যন্ত প্রায় সকল ডিভাইজ গুলোতেই বর্তমানে ফেস লক সিস্টেম দেখা যাচ্ছে। একেক ডিভাইজে একেক টেক ইউজ করা হয়েছে। যেগুলো শুধু ক্যামেরা দিয়ে কাজ করে, সেগুলো কম সিকিউর তবে আলাদা ম্যাকানিজম ও নানান সেন্সরের সাহায্যে কাজ করা ফেস লক সিস্টেম শুধু ক্যামেরা ইউজ করে ফেস লক সিস্টেম থেকে বেশি সিকিউর।
অনেকে তো ফোনে পিন, পাসওয়ার্ড কিছুই ইউজ করেন না, তবে তাদের কাছে ফেস আইডি অনেক সহজ একটি ব্যাপার। ফোনের দিকে জাস্ট তাকালেন আর ফোন খুলে গেলো, কিন্তু আপনার ফেস ছাড়া সেটি খুলবে না! অসাধারণ ব্যাপার না? দেখুন যদি বলি ইউজ করা কতোটা সহজ, তো ইয়েস ফেস আইডি ইউজ করা সবচাইতে সহজ। আপনাকে কিছুই মনে রাখতে হবে না, উল্টে আপনার ফোনই আপনার ফেস মনে রাখবে। কিন্তু যদি বলি এটা কতোটা সিকিউর? সেক্ষেত্রে প্রশ্ন আলাদা হবে। হ্যাঁ, অবশ্যই হ্যাকারের কাছে আপনার ফেস নেই, কিন্তু আপনাকে জোর করে সহজেই কেউ আপনার ফোন আনলক করিয়ে নিতে পারবে, সেটা ফেস লক, ফিঙ্গারপ্রিন্ট বা যেকোনো বায়োমেট্রিক সিকিরিটির ক্ষেত্রে!
আপনি কাউকে পাসওয়ার্ড মুখে বলে দেওয়ার পূর্বে কেউ আপনার মুখের সামনে ফোনটি ধরে আনলক করে ফেলা অনেক সহজ ব্যাপার। যদিও সকল ফেস লক হয়তো এভাবে কাজ করবে না, বাট অনেক ফেস লক সিস্টেমে ধরুন আপনি পাশে ফোন রেখে ঘুমাচ্ছেন, আপনার ফেসের সামনে ধরলেই ফোনটি আনলক হয়ে যাবে! তাহলে এর নিরাপত্তা কথায়? ইউটিউবে অনেক টেস্টে দেখা যায় জাস্ট আপনার ফটো দেখিয়ে ফোনের সিস্টেমকে বোকা বানানো সম্ভব!
২. ফিঙ্গারপ্রিন্ট:
প্রথমে ফিঙ্গারপ্রিন্টের সুবিধা গুলো নিয়ে আলোচনা করা যাক। মিথ্যা বলবো না, আমি নিজেও ফিঙ্গারপ্রিন্ট ইউজ করার বিরাট ফ্যান, কেননা এটি অনেক বেশি ফাস্ট! হ্যাঁ পাসওয়ার্ড বা পিন প্রবেশ করানো আরো বেশি সিকিউর কিন্তু কেউ যদি আমার অজান্তে পাস থেকে পাসওয়ার্ড গেস করে ব্যাস কেল্লা ফতেহ! ফিঙ্গারপ্রিন্ট কেউ গেস করতে পারবে না। সবচাইতে বড় কথা হচ্ছে এটা সবচাইতে বেশি ফাস্ট!
যাদের মস্তিষ্ক অত্যন্ত বেশি ধারালো, মাত্র চার সংখ্যার পিন সেটাও সহজেই যারা ভুলে শেষ করে ফেলে, ফিঙ্গারপ্রিন্ট তাদের জন্য স্বর্গের পাঠানো সিকিউরিটি সিস্টেম! তাহলে কি ফিঙ্গারপ্রিন্টই আজকের বিজয়ী? দাঁড়ান! খেলা কেবল তো শুরু হলো!
এবার চলুন, এর খারাপ দিক গুলো নিয়ে আলোচনা করা যাক। হ্যাঁ ফিঙ্গারপ্রিন্ট ইউনিক জিনিষ, সেটা রিপ্লেস করা সম্ভব নয়। কিন্তু হ্যাকারদের কাছে রয়েছে মারাত্মক ব্রিলিয়ান্ট সকল পদ্ধতি। ২০১৩ সালে জার্মানির Chaos Computer Club কাঁচ থেকে ফিঙ্গারপ্রিন্ট উদ্ধার করে এটার হাই রেজুলেশন ইমেজ তৈরি করে যেটার মধ্যে ফিঙ্গারপ্রিন্টের মারাত্মক বর্ণনা ছিল। তারপরে সেই ইমেজ থেকে সেন্সরকে বোকা বানানোর জন্য রাবারের মতো একটি ফিঙ্গারপ্রিন্ট তৈরি করে, যেটার দ্বারা সহজেই ফিঙ্গারপ্রিন্ট সেন্সরকে তারা বোকা বানাতে সক্ষম হয়।
যদি বলি কয়েকদিন পূর্বের কথা সেক্ষেত্রে স্যামসাং গ্যালাক্সি এস১০ এর হাই টেক অ্যাল্ট্রা সনিক ফিঙ্গারপ্রিন্ট রিডারকেও বোকা বানানো হয়েছিলো এক 3D প্রিন্ট করা ফিঙ্গার এর সাহায্যে। হ্যাকার যদি আপনার ফোন চুরি করে সেক্ষেত্রে অবশ্যই পূর্বে থেকে আপনার ফোনে আপনার ফিঙ্গারপ্রিন্ট থাকবে, জাস্ট সেগুলোকে খুঁজে বের করে কম্পিউটারে হাই রেজুলেশন ইমেজ তৈরি করতে পারলেই কাজ শেষ!
৩. পাসওয়ার্ড:
যদি সিকিউরিটির কথা বলি র্যান্ডম পাসওয়ার্ড তৈরি করে ফোন লক করা সবচাইতে বেস্ট সিকিউরড পদ্ধতি কিন্তু দিনে আপনি কতোবার ফোন আনলক করে? ৫০-১০০ বার বা আরো বেশি হতে পারে। তো এতোবার বারবার করে সেই কমপ্লেক্স পাসওয়ার্ড প্রবেশ করানো বিরাট এক প্যারার কাজ। অনেকে তো চার সংখ্যার পিন মনে রাখতে সক্ষম নয়। তাদের কাছে কমপ্লেক্স পাসওয়ার্ড তো অনেক দূরের ব্যাপার।
পাসওয়ার্ড অনেক স্লো, আপনি কতো কমপ্লেক্স পাসওয়ার্ড সেট করেছেন সে অনুসারে আনলক করতে ততো বেশি সময় লাগতে পারে। ইমারজেন্সি অবস্থায় পাসওয়ার্ড দ্রুত খুলতে সমস্যা হতে পারে, পাসওয়ার্ড বারবার ভুল প্রবেশ করালে ফোন আনলক হওয়া থেকে কয়েক মিনিট বা ঘণ্টার জন্য ব্যান হয়ে যেতে পারে।
৪. পিন:
পিন ব্যবহার করা ফেস লক বা ফিঙ্গারপ্রিন্টের মতো এতো অ্যাডাভান্সড নয় আবার পাসওয়ার্ডের মতো অত্যাধিক মাত্রায় সিকিউরড ও নয়। তবে পিন কতোটা নিরাপদ সেটা নির্ভর করে আপনি কোন ডিভাইজ ইউজ করেন তার উপরে। অনেক ডিভাইজ রয়েছে যেগুলোতে নির্দিষ্ট পরিমাণে ভুল পিন কোড প্রবেশ করালেই ডিভাইজ থেকে স্বয়ংক্রিয় সকল ডাটা গুলো মুছে যাবে। যদি আপনি পরিচিত কেউ ফোনটি আনলক করার চেষ্টা করে সেক্ষেত্রে তার অনুমান মিলে গেলে ফোনটি আনলক হয়ে যেতে পারে, যদি না হয় সেক্ষেত্রে সকল ডাটা গুলো ইরেজ হয়ে যাবে।
পিনের সুবিধা হচ্ছে আপনি ইচ্ছা মতো সেটাকে পরিবর্তন করতে পারবেন, যেটা ফেস লকের ক্ষেত্রে বা ফিঙ্গারপ্রিন্টে সম্ভব নয়। হ্যাঁ, পাসওয়ার্ড ও ইচ্ছা মতো পরিবর্তন করতে পারবেন, কিন্তু সেগুলোকে মনে রাখা কষ্টের। পিন সে তুলনায় মনে রাখা সহজ, কেননা মাত্র কয়েকটি সংখ্যায় যুক্ত থাকে। আপনার পিন যদি কেউ গেস করে ফেলে সেক্ষেত্রে সহজেই পিন পরিবর্তন করে হ্যাক হওয়া থেকে বাঁচতে পারেন। যেখানে বায়োমেট্রিক সিকিউরিটি পরিবর্তন করার পদ্ধতি নেই। মানে কারো কাছে আপনার ফিঙ্গারপ্রিন্টের হুবহু মডেল থাকলে বারবার আপনার সকল ডিভাইজই বাইপাস করে ফেলতে পারবে, যদিও এতে হাই টেক প্রয়োজনীয়!
পিনেও কিন্তু অসুবিধা রয়েছে, এক দিক থেকে বলতে গেলে পিন ক্র্যাক করা সব চাইতে সহজ ব্যাপার। শুধু হ্যাকারের হাতে যদি যথেষ্ট সময় থাকে ব্রুট ফোর্স অ্যাটাক মেরে আপনার পিন বের করে ফেলতে পারবে। যদি পিনের সাথে এক্সট্রা সিকিউরিটি থাকে, ব্রুট ফোর্স প্রটেকশন থাকে সেক্ষেত্রে পিন ক্র্যাক করা মুশকিল হতে পারে।
৪ সংখ্যার পিনের সিকিউরিটি লেভেল এক আবার ৬ সংখ্যার পিনের সিকিউরিটি লেভেল আরেক। এই হিসেবে দেখতে গেলে প্যাটার্ন লক ইউজ করা বেশি সিকিউরড, বাট গবেষকগন এটাও প্রমান করে দেখিয়েছেন যে প্যাটার্ন লক ও তেমন সিকিউরড নয়। হ্যাকারের কাছে এমন সফটওয়্যার টুলস ও রয়েছে যেটা আপনার ফোন বন্ধ রেখেই পিন ট্রায় করতে পারে, মানে ভুল পিন প্রবেশ করালেও সেটা ফোন গুনতে পারবে না, ফলে আরামে ব্রুট ফোর্স অ্যাটাক চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।
ফেস, ফিঙ্গারপ্রিন্ট, পাসওয়ার্ড, পিন এর মধ্যে কোন লকটি সবচেয়ে বেশি নিরাপদ?
এতোক্ষণে আশা করছি এটুকু বুঝতে সক্ষম হয়েছেন, এর কোন ফিক্সড উত্তর নেই যে কোনটি আপনার জন্য বেস্ট। প্রথমে সকলের সুবিধা ও অসুবিধা গুলো জানতে হবে যেগুলো আমি অলরেডি আলোচনা করলাম, তারপরে আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোনটি আপনার জন্য বেস্ট কাজ করবে। ফেস, ফিঙ্গারপ্রিন্ট, পাসওয়ার্ড, পিন সকলেরই কিছু সুবিধা ও অসুবিধা রয়েছে। যদি কথা বলি ফাস্ট আনলক স্পিড সাথে ডিসেন্ট সিকিউরিটি সেক্ষেত্রে ফিঙ্গারপ্রিন্টের সাথে চিপ্টে লেগে থাকুন কোনই সমস্যা নেই। যদি হাই লেভেল সিকিউরিটি দরকার হয় জাস্ট র্যান্ডম ও লং পাসওয়ার্ড ইউজ করুণ, আপনি পিন ও ব্যবহার করতে পারেন।
যদি আপনার ফোনের ফেস আইডি হাইটেক হয়, আপনি সেটাও ইউজ করতে পারেন, শুধু ক্যামেরা ইউজ করে ফেস লক সিস্টেম না ইউজ করায় বেটার! এখন যদি কথা বলি সিকিউরিটি নিয়ে এবং আপনি কার থেকে নিরাপদ থাকছে চাচ্ছেন সেই প্রসঙ্গ নিয়ে। তো দেখুন, যদি সরকার থেকে সিকিউর থাকতে চান, সেটা সম্ভব নয়। সরকার আপনাকে সবকিছু করাতে বাধ্য করতে পারে। যদি র্যান্ডম চোর ছেঁচরা বা পরিবারের কারো কাছ থেকে সিউকিউর থাকতে চান সেক্ষেত্রে ফিঙ্গারপ্রিন্ট বা পিন দুটোই ইউজ করতে পারেন। তবে বেস্ট সিকিউরিটি নিশ্চিত করার জন্য নিজের কমন সেন্স ইউজ করতে হবে। আর নিজেকেই বেঁছে নিতে হবে কোনটি আপনার জন্য বেস্ট পদ্ধতি!
কার্টেসি: