রেমিট্যান্স আহরণে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের ভূমিকা

বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের চলমান সংকটের মধ্যেও প্রবাসী আয়ে ঊর্ধ্বমুখী ধারা অব্যাহত রয়েছে। করোনা মহামারির মধ্যেই চলতি বছরের নভেম্বরের মাত্র ১২ দিনে ১.৬৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ২৫ দিনে ২.০০ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আসার রেকর্ড হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে একক মাসের মাত্র ১২ দিনে এর আগে কখনো এত পরিমাণ রেমিট্যান্স আসেনি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি একটি বিরল ঘটনা। চলতি ২০২০-২০২১ অর্থবছরে জুলাই থেকে ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত মোট রেমিট্যান্স এসেছে ১ হাজার ৪ কোটি ১৬ লাখ (১০.১৬ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার। যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ৪২ শতাংশ বেশি। গত ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে এ একই সময়ে রেমিট্যান্স এসেছিল ৭০৭ কোটি ৩০ লাখ (৭.৩০ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার। রেমিট্যান্সের বিদ্যমান ধারা অব্যাহত থাকায় অক্টোবর ২০২০ মাসের শেষে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪০.৮২ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছছে এবং ২৬ নভেম্বর ৪১.৩০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে।
প্রবাসী রেমিট্যান্স যোদ্ধারা দেশের রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধিতে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছেন। তারা চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসেই আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪৩ শতাংশ বেশি রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন। রেমিট্যান্স প্রবাহের এমন জোয়ারে বড় ভূমিকা রাখছে এজেন্ট ব্যাংকিং। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর—এ তিন মাসেই দেশে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ১১ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকার রেমিট্যান্স এসেছে। দেশে করোনাভাইরাস ভয়াবহ মাত্রায় ছড়িয়ে পড়ার পর এজেন্টদের মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রবাহ দ্বিগুণ হয়েছে। এপ্রিল থেকে জুন এ তিন মাসে এজেন্টদের মাধ্যমে ৭ হাজার ১১৫ কোটি টাকার রেমিট্যান্স আসে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে মোট রেমিট্যান্স এসেছিল ১৫ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকা। আর চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নয় মাসেই এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ২২ হাজার ৮০১ কোটি টাকার রেমিট্যান্স এসেছে। এক বছরের ব্যবধানে এজেন্ট ব্যাংকিং সেবায় রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২২১ শতাংশ।
মূলত দেশ বিদেশে অর্থ পাচারের প্রধান মাধ্যম হচ্ছে অবৈধ হুন্ডি। অনেকেই এখন বিদেশে অর্থ পাচার করে বাড়ি তৈরি করছে, জমি কিনছে, কারখানা গড়ছে। সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হচ্ছে আমদানি রপ্তানির আড়ালে; আমদানি পণ্যের দাম বেশি দেখিয়ে আর রপ্তানি পণ্যের দাম কম দেখিয়ে অনেকে অর্থ পাচার করছে। হুন্ডির এজেন্টের কাছে রেমিট্যান্সের অর্থ জমা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের আত্মীয়স্বজনের ঠিকানায় হুন্ডির টাকা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। হুন্ডির সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো এটি সরকারের হিসেবে নথিভুক্ত হয় না এবং দেশের অর্থনীতির জন্য এটি একটি বড় শত্রু। এক শ্রেণির তথাকথিত ব্যবসায়ী, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট, আমদানিকারক ও মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার- পর্দার আড়ালে হুন্ডি কারবারে জড়িত। সরকারের সাম্প্রতিক নানামুখী পদক্ষেপের কারণে হুন্ডি ব্যবসায় ধস নামা শুরু করেছে।
আমদানি বা রপ্তানির মাধ্যমে টাকা পাচার করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের ডকুমেন্ট বা কাগজপত্র প্রদর্শন করতে হয়। এর ফলে অপরাধীর পরিচয় একসময় সনাক্ত করা যায়। কিন্তু হুন্ডিতে মূলত এজেন্টের মাধ্যমে যে টাকা লেনদেন হয়, সেটি পুরোপুরি চলে বিশ্বাসের ওপর। এখানে কোনো কাগজপত্রের লেনদেন হয় না। এ প্রক্রিয়ায় টাকা পাচার করা হলে পাচারকারীদের শনাক্ত করা খুবই কঠিন। এ ছাড়া হুন্ডির মাধ্যমে টাকা স্থানান্তরে খরচ কম। এ কারণেই পাচারকারীরা হুন্ডিকেই পছন্দ করে বেশি। শুধু বাংলাদেশ থেকে টাকা যায় না, টাকা আসেও হুন্ডির মাধ্যমে। বৈধপথে অর্থ পাঠানোর ক্ষেত্রে অনেক সময় কিছু সমস্যা থাকায় প্রবাসী শ্রমিকরাও হুন্ডির আশ্রয় নিয়ে দেশে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। যারা অবৈধভাবে পালিয়ে বিদেশে অবস্থান করছে, মূলত তারাই বাধ্য হয়ে হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) এক জরিপে দেখা যায়, প্রবাসীরা বিদেশ থেকে দেশে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠান তার ৪০ শতাংশ আসে ব্যাংকিং চ্যানেলে। ৩০ শতাংশ আসে সরাসরি প্রবাসী বা তাদের আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে নগদ আকারে এবং বাকি ৩০ শতাংশ আসে হুন্ডির মাধ্যমে।
অবৈধ হুন্ডি প্রতিরোধের কারণে বৈধপথে দেশে রেমিট্যান্স আহরণ বহুলাংশে বেড়েছে। অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বৈধপথে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে। প্রবাসীরা এখন অনেক সচেতন। তারা অবৈধ পথ এড়িয়ে বৈধপথেই রেমিট্যান্স পাঠাতে আগ্রহী হচ্ছেন। বৈধপথে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স বেড়েছে, শুধু বাড়েনি, নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। ফলে এটা বলাই যায়, অবৈধ পথের (হুন্ডি) মাধ্যমে বিদেশ থেকে অর্থ পাঠানোর প্রবাহ কমেছে। দেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচার করা অপরাধ, যা বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করে। এই হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচার ঠেকাতে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো সব সময়ই তৎপর আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে হুন্ডির কোনো তথ্য থাকে না। তবে বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অর্থ পাচার নিয়ে যারা কাজ করে, এর মধ্যে জিএফআই অন্যতম। তাদের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী আমাদের দেশ থেকে অর্থ পাচারের পরিমাণ কমেছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যাংকাররা বলছেন, আগে রেমিট্যান্সের অর্থ গ্রহণের জন্য গ্রাহকদের ব্যাংকের শাখায় আসতে হতো। দূরত্ব, শারীরিক ও আর্থিক ঝুঁকির কারণে অনেক প্রবাসী পরিবারই ব্যাংকের শাখায় এসে টাকা নিতে অস্বস্তিতে থাকত। এর সুযোগই নিত অবৈধ হুন্ডি কারবারিরা। তাদের নিয়োগ দেয়া লোকেরা অবৈধ পথে আসা রেমিট্যান্সের অর্থ প্রবাসী পরিবারে পৌঁছে দিত। এখন বাড়ির পাশের বাজারে ব্যাংকগুলোর এজেন্ট পৌঁছে গেছে। ফলে নিরাপদ মাধ্যমে প্রবাসী পরিবারের সদস্যরা রেমিট্যান্সের অর্থ উত্তোলন করতে পারছেন। অনেক ক্ষেত্রে এজেন্টরাই উপকারভোগীদের ঘরে রেমিট্যান্সের অর্থ পৌঁছে দিচ্ছেন। আবার অনেক সুবিধাভোগীর এজেন্ট ব্যাংকিং হিসেবে রেমিট্যান্স জমা হচ্ছে এবং জমা হওয়ার তথ্য মোবাইল মেসেজে চলে যাচ্ছে। এতে প্রবাসীদের কাছে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের জনপ্রিয়তা বাড়ছে, যা রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখছে। সেই সঙ্গে রেমিট্যান্সকে কেন্দ্র করে হুন্ডির তৎপরতা প্রায় বন্ধ হয়ে এসেছে।
এজেন্টদের মাধ্যমে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ স্বজনদের কাছে পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করছে ২৪টি ব্যাংক। তবে এ চেষ্টায় সবচেয়ে বেশি সফলতা পেয়েছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। দেশে এখন পর্যন্ত এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে যে রেমিট্যান্স এসেছে তার ৪৫ শতাংশই এসেছে ব্যাংকটির মাধ্যমে। এক্ষেত্রে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ডাচ-বাংলা ব্যাংক। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে রেমিট্যান্স আহরণে শীর্ষ পাঁচে থাকা অন্য ব্যাংকগুলো হলো ব্যাংক এশিয়া, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক ও অগ্রণী ব্যাংক।
ইসলামী ব্যাংকের রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধিতে এজেন্টরা বড় ভূমিকা রাখছে বলে গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। ইসলামী ব্যাংক নব্বইয়ের দশক থেকেই মধ্য প্রাচ্যের প্রবাসী বাংলাদেশীদের কাছে বেশ বিশ্বস্ততা অর্জন করেছে। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ব্যাংকটি প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ আমানতদারিতার সঙ্গে তাদের স্বজনদের বুঝিয়ে দেয়ার দায়িত্ব নিষ্ঠা ও সততার সাথে পালন করে আসছে। মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ দেশের প্রধান শ্রমবাজারগুলোতে অবস্থানকারী বাংলাদেশীদের অর্ধেকের বেশি হিসাব ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে শাখা না থাকায় অতীতে গ্রাহকদের একটি অংশ অন্য ব্যাংক বা হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠাত। এজেন্ট ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইসলামী ব্যাংকের সেবা ছড়িয়ে পড়েছে। তাছাড়া, ব্যাংকটি সরকার ঘোষিত ২শতাংশ নগদ প্রণোদনার সাথে নিজস্ব উদ্যোগে এজেন্ট ব্যাংকিং এ যাদের হিসাব রয়েছে, তাদের আরও ১ শতাংশ প্রণোদনা দিয়ে আসছিল। ফলে গ্রাহকরা এজেন্টদের মাধ্যমে আগের চেয়ে বেশি অর্থ পাঠাচ্ছেন। প্রবাসীদের স্বজনরা বাড়ির পাশের বাজার থেকে টাকা তুলতে পারছে আবার অনেকের হিসাবে রেমিট্যান্স জমা হয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে ব্যাংকের রেমিট্যান্স প্রবাহ আরো বাড়বে বলে সংশ্লিষ্টদের দৃঢ় বিশ্বাস।
দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীকে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির আওতায় নিয়ে আসার লক্ষ্য নিয়ে ২০১৪ সালে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের যাত্রা। কার্যক্রম শুরুর ছয় বছরের মধ্যেই গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছে সেবাটি। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ২৮টি ব্যাংক লাইসেন্স নিয়েছে। ২৪টি ব্যাংক এরই মধ্যে সেবাটি চালু করেছে। এ ব্যাংকগুলো নিয়োগ দিয়েছে ১০ হাজার ১৬৩ এজেন্ট। নিয়োগপ্রাপ্ত এজেন্টরা ১৪ হাজার ১৬টি আউটলেট চালু করেছেন। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এজেন্টদের মাধ্যমে ৩৮ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকার রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় দেশে এসেছে। এজেন্টদের মাধ্যমে আসা রেমিট্যান্সের ৯০ শতাংশই গ্রামাঞ্চলের আউটলেটগুলোর।
বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানি খাতে রেমিট্যান্স আয় আরো বাড়ানোর জন্য হুন্ডি প্রতিরোধ করার জন্য সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক নানামুখি পদক্ষেপ নিয়েছে কিন্তু পুরোপুরি বন্ধ করা যায়নি। ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রেরণ করার ক্ষেত্রে কিছু অসুবিধা থাকায় প্রবাসীদের অনেকেই বাধ্য হয়ে হুন্ডির মাধ্যমে তাদের টাকা দেশে প্রেরণ করছে। তবে গত অর্থবছরে চালু করা ২ শতাংশ নগদ প্রণোদনা হুন্ডি প্রতিরোধে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে।
এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের বিস্তার অবৈধ হুন্ডি তৎপরতা বন্ধে কার্যকর অগ্রনী ভূমিকা রাখছে। দেশের প্রতিটি থানা, বড় বন্দর বা বাজারে এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে গেছে। এজেন্টরা খুব সহজে ও দ্রুত প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ তাদের স্বজনদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। এতে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে হুন্ডি তৎপরতা কমে এসেছে। এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা যত বেশি বিস্তৃত ও সমৃদ্ধ হবে, হুন্ডির তৎপরতা তত বেশি কমবে। শেয়ার বিজ।