নিজস্ব সক্ষমতায় চলছে ইসলামী ব্যাংকগুলো

দেশের ইসলামী ব্যাংকসহ শরিয়াহভিত্তিক সব ব্যাংকই নিজস্ব সক্ষমতায় ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সম্প্রতি একটি মহল তারল্য সঙ্কটের কথা বলে শরিয়াহভিত্তিক সব ব্যাংকগুলোর বিষয়ে নানা ধরনের গুজব ছড়ায়। তবে সব ধরনের গুজবকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে সক্ষমতার সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে ব্যাংকগুলো।

ব্যাংক খাতে সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা বলছেন, শুধু শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক নয়, বর্তমানে দেশের কোনো ব্যাংকেই কোনো সমস্যা নেই। সব ব্যাংকই দুর্বার গতিতে দেশ ও দেশবাসীর সেবা দিয়ে যাচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সারাবিশ্বে মহামারি করোনার পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতিতে ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে। যার প্রভাব দেশেও পড়েছে। তবে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে সব ধরনের সমস্যা কাটিয়ে উঠছে।

টেকনো ইনফো বিডি'র প্রিয় পাঠক: প্রযুক্তি, ব্যাংকিং ও চাকরির গুরুত্বপূর্ণ খবরের আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ এবং টেলিগ্রাম চ্যানেল এ লাইক দিয়ে আমাদের সাথেই থাকুন।

তারল্য সঙ্কটে পড়া ইসলামী ব্যাংকসহ শরিয়াহভিত্তিক পাঁচটি ব্যাংককে বিশেষ সুবিধায় মাত্র একদিনের জন্য টাকা ধার দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মাধ্যমে ব্যাংক পাঁচটিকে গত বছরের শেষ কার্যদিবসে প্রকৃত চিত্রের পরিবর্তে আর্থিক সূচকগুলো তুলনামূলক কিছুটা ভালো দেখানোর সুযোগ পায়।

ব্যাংক পাঁচটিকে দেওয়া তারল্যসুবিধার পরিমাণ ছিল ১৪ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা। এতে মুনাফার হার ছিল আট দশমিক ৭৫ শতাংশ। তবে ঋণের এই টাকা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো কোনো কাজে ব্যবহার করেনি। রাতে ঋণ দিয়ে সকালেই অটো ডেবিট করে নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংক পাঁচটি হলো- ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড (এসআইবিএল) ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক।

নিয়ম অনুযায়ী, ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোকে আমানতের সাড়ে পাঁচ শতাংশ এসএলআর ও চার শতাংশ সিআরআর হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকে রাখতে হয়। ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোকে দৈনিক ভিত্তিতে আমানতের ন্যূনতম সাড়ে তিন শতাংশ ও দ্বিসাপ্তাহিক ভিত্তিতে চার শতাংশ অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখতে হয়। চাহিদা অনুযায়ী জমা রাখতে ব্যর্থ হলে গুনতে হয় জরিমানা। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহের বেশির ভাগ দিনই এই পাঁচ ব্যাংক চাহিদা অনুযায়ী সিআরআর রাখতে পারেনি। ফলে ২৯ ডিসেম্বর ইসলামী ব্যাংকের পাঁচ হাজার ৫০ কোটি টাকা, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের এক হাজার ৫৮০ কোটি টাকা, ইউনিয়ন ব্যাংকের ৫৪১ কোটি টাকা, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ৩০৫ কোটি টাকা ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ৮২ কোটি টাকা সিআরআর ঘাটতি ছিল।

এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ দেশের সবচেয়ে বড় ব্যাংক। এটি দেশে ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর অন্যতম অর্থ জোগানদাতাও। তাই এটি তারল্য সঙ্কটে পড়ায় অন্য ইসলামী ব্যাংকগুলোয় প্রভাব পড়ে। এসব ব্যাংককে প্রায় আট হাজার কোটি টাকা জমা ও ধার দিয়েছে ইসলামী ব্যাংক, যা সময়মতো ফেরত পায়নি। এতে দেশের বৃহত্তম ব্যাংকটি কিছুটা তারল্য সঙ্কটে পড়ে। এ কারণে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডকে আট হাজার কোটি টাকা একদিনের জন্য ঋণ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক গত ২৯ নভেম্বর এক চিঠিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানায়, গ্রাহকদের অতিরিক্ত আমানত উত্তোলনের কারণে সিআরআর ও এসএলআর ঘাটতি হয়েছে। এ জন্য ব্যাংকটি একদিনের জন্য তিন হাজার ১২৫ কোটি টাকা ধার চেয়ে আবেদন করে। বছরের আর্থিক বিবরণীতে সিআরআর ও এসএলআর ঘাটতির তথ্য প্রকাশ হলে আমানতকারীদের আস্থার সঙ্কট আরো ঘনীভূত হতে পারে, এই বিবেচনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক দিনের জন্য তিন হাজার ১২৫ কোটি টাকা ধার দেয়।

ইউনিয়ন ব্যাংক একই কারণ দেখিয়ে এক হাজার ৬৪৫ কোটি টাকা ধার চায়। ব্যাংকটির নভেম্বর ও ডিসেম্বরে সিআরআর ঘাটতি ছিল ১৮ দিন। ২৮ ডিসেম্বর ঘাটতি হয় ৫২৬ কোটি টাকা। এসআইবিএলও একই কারণ দেখিয়ে এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা ধার চায়। নভেম্বর ও ডিসেম্বরে ব্যাংকটির সিআরআর ঘাটতি ছিল ৩০ দিন। ২৮ ডিসেম্বর ঘাটতি হয় ৮৯৯ কোটি টাকা। গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকও একই কারণ দেখিয়ে ৭০০ কোটি টাকা ধার চায়। ডিসেম্বর মাসে ব্যাংকটির সিআরআর ঘাটতি ছিল সাত দিন। এর মধ্যে ২৮ ডিসেম্বর ঘাটতি হয় ১০৭ কোটি টাকা।

ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, করপোরেট ও সাধারণ গ্রাহকের আমানত কমে যাওয়ায় গত নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে দায়সহ আমানতের বিপরীতে বেশির ভাগ দিন সিআরআর ও বিধি বন্ধ জমা (এসএলআর) রাখা সম্ভব হয়নি। বছরভিত্তিক হিসাবেও যাতে সিআরআর ঘাটতি না থাকে, এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরামর্শেই বিরল এই সুবিধায় টাকা ধার নেওয়া হয়। পরদিনই পুরো টাকা ফেরত দেওয়া হয়।

এ প্রসঙ্গে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ হাবিব হাসনাত বলেন, বছরের শেষ মাসে অনেক আমানতের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এর মধ্যে কেউ উত্তোলন করেন, আবার কেউ নতুন করে রাখেন। এদিকে মেয়াদ পূর্ণ হওয়ায় ইসলামী ব্যাংককে তাদের আমানত ফেরত দেওয়া হয়েছে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চাহিদানুযায়ী প্রতিদিন টাকা জমা রাখা যায়নি। তবে এ পরিস্থিতি এখন মোটামুটি ভালো হয়েছে।

এসআইবিএলের এমডি জাফর আলম বলেন, বর্তমানে ব্যাংকে কোনো সমস্যা নেই। ইসলামী ব্যাংকগুলোর জন্য টাকা ধার নেওয়ার সুযোগ কম। এজন্য বিশেষ ব্যবস্থায় টাকা নেওয়া হয়েছে। গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের এমডি সৈয়দ হাবিব হাসনাত বলেন, দুটি ব্যাংক তাদের টাকা সময়মতো ফেরত দেয়নি। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার করে বছরের শেষ দিনে সিআরআর রাখতে হয়েছে। তবে বর্তমানে সমস্যা অনেকাংশে দূর হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা সূত্রে জানা গেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার নিতে হলে ব্যাংকগুলোকে বিল, বন্ড লিয়েন রাখতে হয়। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ধার দিতে পারে না। টাকা ধার নিতে এই পাঁচ ব্যাংকের কাছে ব্যবহারযোগ্য সুকুক বন্ড নেই। এ জন্য ‘প্রমিসারি ডিমান্ড নোট’ প্রদান করে টাকা ধার করতে হয় ব্যাংক পাঁচটিকে। এর মাধ্যমে যেকোনো উপায়ে টাকা ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় ব্যাংকগুলো। এই কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক এক দিনের জন্য এই টাকা ধার দেয়। যার মাধ্যমে ব্যাংক পাঁচটি গত ২৯ ডিসেম্বর বছরের শেষ কার্যদিবসে চাহিদা মোতাবেক কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অর্থ জমা রাখতে (সিআরআর) সক্ষম হয়।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, দেশের ব্যাংকিং খাত বেশ শক্ত অবস্থানে রয়েছে। দেশবাসীকে কোনো গুজবে কান না দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, বছরের শেষ দিকে ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর মধ্যে পাঁচটি ব্যাংকের তারল্যে কিছুটা ঘাটতি পড়ে। বছর ক্লোজিংয়ের কারণে তাদের কিছুটা সুবিধা দিতে ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের আবেদনের প্রেক্ষিতে মাত্র একদিনের জন্য কিছু টাকা ঋণ দেওয়ার চিন্তা করা হয়। তবে টাকা ধার নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর কাছে কোনো বন্ড ছিল না। এ জন্য ঋণের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে কিছু টাকা ধার দেওয়া হয়। পরের দিনই সকালে আবার সেই টাকা ফেরত নেওয়া হয়েছে। তবে সিআরআর ঘাটতির জন্য নিয়মানুযায়ী তাদের জরিমানা গুনতে হবে।

আরও দেখুন:
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তারল্য সহায়তা গ্রহণের বিষয়ে ইসলামী ব্যাংকের বক্তব্য
বিদায়ী বছরে ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা বেড়েছে, শীর্ষে ইসলামী ব্যাংক
ইসলামী ব্যাংক এখন দেশের ব্যাংক খাতের মেরুদণ্ড

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরো বলেন, আগামীতে তারল্য পরিস্থিতির উন্নতি করার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে সতর্ক ও কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

Related Articles

Leave a Reply

Back to top button