বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন ইমতিয়াজ আর চৌধুরী নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের (এফআরবিএনওয়াই) নিরীক্ষা তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে কাজ করছেন। এ পদে থাকায় তাঁকে বেশ কয়েকটি ব্যাংকের ব্যবসায়িক ক্ষেত্র নিরীক্ষণের দায়িত্ব পালন করতে হয়।
নিউইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক যুক্তরাষ্ট্রের ১২টি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের একটি। নিউইয়র্ক নগরের ৩৩ লিবার্টি স্ট্রিটে এই ব্যাংকের সদর দপ্তর। ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমের মধ্যে কাজ করার মাধ্যমে নিউইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক আর্থিক নীতি প্রয়োগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ এবং দেশের অর্থ প্রদান ব্যবস্থা বজায় রাখতে সহায়তা করে থাকে।
বাংলাদেশে ‘এ’ লেভেল পাস করে ২০০৭ সালের জুলাইয়ে ইমিগ্রান্ট ভিসায় যুক্তরাষ্ট্রে আসেন ইমতিয়াজ চৌধুরী। জন্ম ঢাকায় হলেও বেড়ে ওঠা সিলেট শহরে।
বারুক কলেজ থেকে হিসাববিজ্ঞানে বিবিএ পাসের পর একটি জার্মান ব্যাংকের নিউইয়র্ক শাখায় যোগ দেন ২০১১ সালে। কলেজে পড়ার সময় ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অফ নিউইয়র্কের অডিটর জেনারেলের সঙ্গে এক নেটওয়ার্কিং ইভেন্টে পরিচয় হয়। পরে তিনি তাঁকে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে কাজের জন্য রেফার করেন। কয়েক ধাপ পরীক্ষা শেষে ২০১২ সালের জুলাইয়ে ফেড-এ যোগ দেন ইমতিয়াজ। অ্যাকাউন্টিং ব্যাকগ্রাউন্ড থাকায় ইন্টারনাল অডিট গ্রুপের প্রতি আগ্রহ ছিল প্রথম থেকেই। তাই ফেড-এর চাকরির প্রস্তাব পেয়ে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেননি তিনি।
এন্ট্রি লেভেল বা জুনিয়র অডিটর হিসেবে যোগ দেওয়ার পর প্রথম ২/৩ বছর অডিট বিষয়ে টেকনিক্যাল অনেক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জন করেন, যা পরবর্তীতে সফলভাবে কাজ করতে সাহায্য করে তাঁকে। বর্তমানে তিনি সুপারভাইজিং অডিটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এই পদে প্রধানত তার কাজ হচ্ছে জুনিয়র অডিটরদের কাজ পর্যালোচনা করে তাদের সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়া। নতুনদের নিয়ে কাজ করতে তার সব সময় ভালো লাগে, আর তাই তিনি তার কাজ বেশ উপভোগ করেন।
বাংলাদেশি তরুণদের নিয়ে তাঁর কোনো ভাবনা আছে কিনা বা তাদের নিয়ে কিছু করতে চান কিনা, এমন প্রশ্ন ইমতিয়াজ বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভিসায় অনেক বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করছে। এ ছাড়া প্রথম প্রজন্মের অনেক বাংলাদেশি অভিবাসীর সন্তান এখন উচ্চশিক্ষায় ভালো ফল করছে। কিন্তু আমরা দেখি, এই প্রতিভাবান শিক্ষার্থীদের গাইড করার, মনিটরিং করার কোনো প্ল্যাটফর্ম নাই। সেই আলোকে আমরা কয়েকজন সমমনা মিলে ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠা করি বাংলাদেশি-আমেরিকান সোসাইটি অফ প্রফেশনালস (বিএসপি) নামে একটি অলাভজনক পেশাজীবী সংগঠন। এরই মধ্যে আমরা প্রায় ২০টি ইভেন্ট আয়োজন করেছি। এ ছাড়া অনেক শিক্ষার্থীকে মূলধারার পূর্ণকালীন, খণ্ডকালীন ও শিক্ষানবীশ কাজ পেতে সহযোগিতা করেছি। বিএসপি সম্প্রতি ইন্টারনাল রেভিনিউ সার্ভিস থেকে ৫০১ (সি) (৩) সংগঠন হিসেবে অনুমোদন পেয়েছে।
ইমতিয়াজ বলেন, এই কাজ করতে গিয়ে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়। একটি অলাভজনক সংগঠন পরিচালনা করা সহজ কাজ নয়। যেহেতু এখানে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে অনেক সময় শ্রম দিতে হয়, তাই অনেকেই সংগঠনের আসতে চায় না। আবার আরেক ধরনের মানুষ আছে যাদের পদ-পদবির লোভ আছে, কিন্তু কোনো কর্মকাণ্ডে পাওয়া যায় না। বিএসপি প্রতিষ্ঠার পর অনেক সফল বাংলাদেশি পেশাজীবী নানা অজুহাতে তাদের ইভেন্টে আসেননি, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।
এই ব্যাংকার বলেন, বিদেশের মাটিতেও ঐক্যবদ্ধ হতে পারছি না, যা লজ্জার।
বিএসপি ছাড়াও শৈলী টেবিল টেনিস ক্লাব অ্যান্ড কালচারাল সেন্টারের সঙ্গে ইমতিয়াজ জড়িত। শৈলীতে তারা বাংলাদেশি বাচ্চাদের টেবিল টেনিস প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন। এ ছাড়া নিয়মিত টুর্নামেন্ট আয়োজন করেন। বিএসপি আর শৈলীর মাধ্যমে বাংলাদেশি কমিউনিটিকে সাহায্য করাই এখন প্রধান লক্ষ্য তাদের।
বাংলাদেশের সঙ্গে এই দেশের কাজের অনেক পার্থক্য আছে বলে মনে করেন ইমতিয়াজ চৌধুরী। তাঁর কাছে মনে হয়, মার্কিন করপোরেট জগতে পারফরমেন্সকেই সবচেয়ে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। এখানে যে অফিস পলিটিকস একেবারে নেই, তা কিন্তু নয়। কিন্তু পারফর্ম করতে না পারলে শুধু পলিটিকস করে টিকা যায় না। বাংলাদেশিরা এখানে অনেক ভালো কাজ করছে, আর তাই তারা সফলও হচ্ছে।
ইমতিয়াজ চৌধুরীর ধারণা, বাংলাদেশিরা কিন্তু ভারতীয়, চাইনিজ, কোরীয়দের থেকে কোনোভাবেই কম দক্ষ নয়। কিন্তু বাংলাদেশে অনেক ভারতীয়, চাইনিজ ম্যানেজমেন্ট লেভেলে কাজ করছে উচ্চ বেতনে। বাংলাদেশের করপোরেট সংস্কৃতি এখনো অনেক পিছিয়ে আছে। বিজনেস লিডারশিপ ক্রাইসিস এর অন্যতম কারণ।
ইমতিয়াজ-রুবাইয়া রসুল চৌধুরী দম্পতির একমাত্র সন্তান জিয়ানা মুমিনাত চৌধুরী। তার বয়স ১০ মাস। এ ছাড়া বাসায় বাবা-মা আছেন। ইমতিয়াজের বাবা জিয়াউস শামস চৌধুরী বাংলাদেশে সাউথইস্ট ব্যাংকের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে অবসরে যান। মা রুকসানা চৌধুরী গৃহিণী।
নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকটি একটি ভল্ট রয়েছে, যা ৮০ মিটার (২৪ মিটার) রাস্তার স্তরের নিচে এবং সমুদ্রতল থেকে ৫০ ফুট (১৫মি) নিচে অবস্থিত। ১৯২৭ সাল নাগাদ এ ভল্টে বিশ্বের আনুমানিক সোনার রিজার্ভের ১০ শতাংশ ছিল। বর্তমানে এটি বিশ্বব্যাপী বৃহত্তম সোনার সংগ্রহস্থল।
ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অফ নিউইয়র্কের প্রায় ৯৮ শতাংশ সোনা বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মালিকানাধীন। বাকিগুলো যুক্তরাষ্ট্র ও আইএমএফের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থার মালিকানাধীন। ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে স্বর্ণের মালিক নেই, তবে এটি বহু মূল্যবান মেটালের অভিভাবক হিসেবে কাজ করে। বারগুলো সরিয়ে রাখতে কর্মীদের জন্য বিশেষ জুতা প্রয়োজন হয়। ভল্ট পর্যটকদের জন্য উম্মুক্ত রাখা হয়।