প্রথম আইফোন ও এর বিবর্তনের ইতিহাস

টেকনো ইনফোঃ আসসালামু আলাইকুম। বন্ধুরা কেমন আছেন? আশা করি সবাই ভালো আছেন। আইফোন প্রযুক্তি বিশ্বের টেক-জায়ান্ট হিসেবে পরিচিত কিন্তু জানেন কি কিভাবে এই কোম্পানিটি বর্তমান বিশ্বে এত জনপ্রিয়তা পেল? যারা জানেন না তাদের জন্য আজকের বিশেষ পোস্ট আইফোন ও এর বিবর্তনের ইতিহাস। আশা করি পোস্টটি আপনাদের ভাল লাগবে।
দু’হাজার সাত সালে বাজারে এসেছিল এমন একটি মোবাইল ফোন – যা সারা বিশ্বের যোগাযোগের প্রযুক্তি এবং এর সামাজিক ভুমিকার ক্ষেত্রে বিপ্লব এনেছিল। সেই ফোনের নাম ছিল আইফোন।
সেই প্রকল্পের একজন প্রকৌশলী ছিলেন এ্যান্ডি গ্রিনিয়ন – বিবিসির এ্যাশলি বায়ার্নের কাছে তিনি বর্ণনা করেছেন আইফোন কি ভাবে তৈরি হয়েছিল সেই সময়ের কথা।
টেকনো ইনফো বিডি'র প্রিয় পাঠক: প্রযুক্তি, ব্যাংকিং ও চাকরির গুরুত্বপূর্ণ খবরের আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ টেকনো ইনফো বিডি এবং টেলিগ্রাম চ্যানেল এ লাইক দিয়ে আমাদের সাথেই থাকুন। |
“যখন প্রথমবার আমরা লোকের হাতে সেই আইফোন দেখতে পেলাম – যা আমরা বছরের পর বছর পরিশ্রম করে বানিয়েছি – তখন তাদের প্রতিক্রিয়া দেখতে পাওয়াটা ছিল এক কথায় দারুণ ব্যাপার “ – বলছিলেন তিনি।
জানুয়ারি ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে এ্যাপল কোম্পানি প্রধান নির্বাহী স্টিভ জবস স্যান ফ্রান্সিসকোয় এক অনুষ্ঠানে প্রথমবারের মতো উন্মোচন করেছিলেন আইফোন নামে এক নতুন ধরণের মোবাইল ফোন – যা বিশ্বের কোটি কোটি লোকের জীবনকে প্রভাবিত করেছে। আজ আমরা যাকে বলি স্মার্টফোন – তার সূচনা এখান থেকেই।
এই ফোনের ছিল একেবারে নতুন ধরণের টাচস্ক্রিন, সহজে ব্যবহার করা যায় এরকম ইন্টারফেস, আর সুন্দর ডিজাইন । সব মিলিয়ে দেখা গেল, একটা আইফোন হাতে থাকলে আপনার যেন আর কিছুরই দরকার নেই। আপনি এতে গান শুনতে পারেন, ছবি তুলতে পারেন, ভিডিও স্ট্রিম করতে পরেন, ই-মেইল করতে পারেন, ইন্টারনেট ব্রাউজ করতে পারেন। তার সাথে ফোনে কথা বলা তো আছেই।
প্রযুক্তির দিক থেকে এটা ছিল এক নতুন দিগন্ত খুলে যাওয়া, এবং সেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আসা লোকেদের আইফোন দেখে রীতিমত তাক লেগে গিয়েছিল।
” আইফোন জিনিসটা লোকের মধ্যে একটা উত্তেজনা তৈরি করেছিল। তাদের ভেতর থেকে সেরা প্রতিক্রিয়াটা বের করে এনেছিল। আইফোনে কি করা যায় – তার এক একটা যখন তাদের দেখানো হচ্ছিল – তারা এমনভাবে চিৎকার করছিল যে আমরা বুঝলাম, তারা জিনিসটা পছন্দ করেছে। “
এ্যান্ডি গ্রিনিয়ন ছিলেন ওই প্রকল্পের একজন সিনিয়র প্রকৌশলী, এর আগে আইপ্যাড তৈরিতেও তার ভুমিকা ছিল। আইপ্যাড ছিল একটা মিউজিক প্লেয়ার। অবশ্য এর আগে থেকেই এ্যাপল কোম্পানি পরিচিত হয়ে উঠেছিল তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ডিজাইনের ম্যাকিন্টশ কম্পিউটার তৈরি করে।
” আমাদের এক বন্ধু ছিল টনি ফেডাল । সে একটা ভিডিও জগ হুইল নিয়ে এলো – যা হচ্ছে ভিডিও এডিটিংএর জন্য ব্যবহৃত একটা গোলাকার ইউএসবি যন্ত্রাংশ। সে বললো, দেখ তো, তোমরা যা করছো – সেই কাজে এটাকে লাগানো যায় কিনা? আমরা তাই করলাম। এবার সে বললো, এখন আমি একটা এ্যাপের নমুনা চাই – যা দিয়ে এমপিথ্রি ফাইল বাজানো যাবে। আমরা বললাম, ঠিক আছে, বানিয়ে দিচ্ছি। আমরা আদৌ জানতাম না যে আমরা আসলে কি বানাচ্ছি। কিন্তু এর পরই যেটা দেখলাম – তাহলো স্টিভ জবস একটা অনুষ্ঠান করলো এবং স্টেজে উঠে লোকের সামনে তুলে ধরলো এই আইপ্যাড। “
কিন্তু সেলফোনের বাজারে এ্যাপলের ঢোকার চিন্তাটা কোথা থেকে এসেছিল?
“এটা আসলে স্বাভাবিক ভাবেই এসেছিল। তবে একটা নতুন ফোন তৈরির আইডিয়াটা এসেছিল মোটরোলা এবং আইটিউনের সাথে আমাদের যে সম্পর্ক ছিল – তার মাধ্যমে। মোটরোলা রকার নামে একটা ফোন তৈরি করলো। সেই ফোনে আইটিউন থেকে মিউজিক বাজিয়ে দেখানো হলো। তবে স্টিভকে সবার বোঝাতে হয়েছিল যে এটা একটা ভালো আইডিয়া। তখন আমাদের নানা রকম আইডিয়া নিয়ে কাজ হচ্ছে, একটা চিন্তা ছিল যে আমরা ফোন বানাতে চাই না, আমরা বরং একটা ওয়াইফাই বানাবো , এবং একটা ফোন সেই ওয়াইফাইতে যুক্ত হলেই শুধু তা দিয়ে কল করা যাবে। শেষ পর্যন্ত স্টিভ রাজী হলো, এবং বললো, চলো তাহলে আমরা ফোনই বানাবো। “
এ্যাপলের একটা বৈশিষ্ট্য ছিল তাদের সৃষ্টিশীল ডিজাইন। কিন্তু প্রথম দিকে তারা পরীক্ষামূলক যে আইফোন বানিয়েছিল – তা কিন্তু প্রথম বাজারে-আসা আইফোনের চাইতে অনেক আলাদা ধরণের ছিল।

” প্রথমে আমরা এমন একটা ফোন বানিয়েছিলাম যা তখনকার দিনে আপনি আমাদের কাছ থেকে আশা করতেন। সেই আইফোন ছিল মূলত একটা আইপড – যা দিয়ে ফোন করা যায়। তাতে আ্ইপডের মতোই গোল ইন্টারফেস ছিল, সবকিছুই ছিল একই রকম। এবং সেটা ব্যবহার করা ছিল খুবই কষ্টকর। “
আইফোনকে বাস্তব রূপ দেবার জন্য স্টিভ জবস এবং এ্যাপলের কর্তারা তাদের সেরা লোকদের দিয়ে একটা দল গঠন করলেন। এ্র্যান্ডি বলছিলেন, তাদের মিটিংগুলোর পরিবেশ খুব আনন্দদায়ক ছিল না।
” যারা সেখানে কথা বলতো কারণ তারা ছিল নিজ নিজ ক্ষেত্রে সেরা। এবং এরকম লোকদের যখন আপনি ছোট্ট একটা ঘরে একসাথে বসাবেন – তখন তাদের ব্যক্তিত্বের সংঘাত হতে বাধ্য। কারো সাথে কারো মত মিলতো না, পুরো ব্যাপরটাই ভেস্তে যাবার অবস্থা। যেমন একটা বৈঠকের কথা বলি। আমি অন্যৗ আরো ক’জনের সাথে একটা ঘরে বসা। তার মধ্যে একজন উঠে আমার পাশের লোকটির কাছে এলেন। তাচ্ছিল্যসূচক কিছু মন্তব্য করলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা বিচ্ছিরি পরিস্থিতি তৈরি হলো। দুজনেই দুজনের উদ্দেশ্যে চিৎকার করতে লাগলেন – ঝগড়ার বিষয় ছিল: কে তার সন্তানদের সাথে বেশি সময় কাটিয়েছে। “
কিন্তু এরা কি জানতেন যে তারা যা নির্মাণ করছেন তার কতটা সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে?
” স্টিভ জানতো যে এই প্রকল্পই হবে এ্যাপলের ভবিষ্যত। কিন্তু এর প্রভাব কি হবে তা সে-ও জানতো না। আমার মনে হয় না যে তার সামনে আমরা কি করবো তার একটা নির্ভুল রোডম্যাপ ছিল। তবে সে জানতো যে স্মার্টফোনের একটা বিরাট বাজার আছে, এবং এর মাধ্যমে অনেক অনেক বেশি লোকের হাতে আমাদের পণ্য পৌঁছে যাবে। “
আইফোন সারা পৃথিবী জুড়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছে কিন্তু কখন তারা বুঝলেন যে তারা বিরাট কিছু করতে যাচ্ছেন?
” আমি এটা বুঝতে পারলাম যখন আমার হাতে প্রথম প্রোটোটাইপ বা পরীক্ষামূলক মডেলটা এলো। সেটা রেখেছিলাম আমার গাড়িতে। তখনকার দিনে জিপিএস অত বড় ব্যাপার ছিল না। রাস্তা চেনার জন্য টমটম ব্যবহার করতাম। আমি অচেনা কোথাও যেতে হলে যেটা করতাম – ম্যাপ কোয়েস্ট বা ওই রকম কোন একটা ওয়েবসাইটে যেতাম। পথের নির্দেশনাটা সেখান থেকে প্রিন্ট করে নিতাম। সেটা দেখে দেখে গাড়ি চালাতাম। এখনকার দিনে মনে হবে প্রায় গুহামানবের মতো প্রযুক্তি। তো সেদিন আমি কোথায় যেন যাচ্ছিলাম। সাথে ম্যাপট্যাপ কিছুই নিই নি। এক সময় পথ হারিয়ে ফেললাম। হঠাৎ আমার মনে হলো, আমি তো আমার এই নতুন ফোনটা থেকেই গুগলে যেতে পারি, পথ খুঁজে বের করতে পারি। আমি তাই করলাম। এবং তখনই আমার মনে হলো – না এই ফোনই সবার সেরা, এর ওপরে আর কিছু হয় না। আমার জীবন বদলে গেল। “
আইফোন এখন তৈরি। এখন এটাকে লোকের সামনে তুলে ধরারর সময়। কিন্তু ঠিক সেই সময়ই আইফোনের সফটওয়্যারে একটা ভাইরাস ধরা পড়লো এবং সব পরিকল্পনা বানচাল হবার উপক্রম হলো।
” তখন চীন থেকে একেবারে নতুন ফোনগুলো তৈরি হয়ে এসেছে। এতে সফটওয়ারটা ভরে দেয়া হবে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এই ফোনগুলোই দেখানো হবে। ফোনগুলোতে সফটওয়ার ভরা শুরু হলো। ঠিক তখনই একটা ভাইরাস ধরা পড়লো যা নতুন ফোন হাতে পাওয়ার আগে পর্যন্ত আমরা ধরতে পারি নি। “
” হচ্ছে কি, ফোনটা চালু করলেই একটা সিকিউরিটী ফিচার চালু হয়ে যাচ্ছে, এবং ফোনটা ভাবছে যে তাকে হ্যাক করা হয়েছে, এবং তার চিপের ভেতরে একটা ফিউজ পুড়ে যাচ্ছে। ফলে আমাদের সেরা ফোনগুলো একে একে কার্যত ইঁটের টুকরোয় পরিণত হলো, এগুলো দিয়ে কোন কিছুই আর করা সম্ভব ছিল না। আমাদের অবশ্য একটা আরো ভালো ফোন ছিল – শেষ পর্যন্ত স্টিভ সেটাই অনুষ্ঠানে দর্শকদের দেখালো। “
” আমার হাতে যে ফোনটা রয়েছে তার সাথে একটা ভিডিও প্রজেক্টর সংযুক্ত করে দেয়া আছে – যাতে আপনারা ফোনটা কি করছে তা দেখতে পারেন। এটা আনলক্ করতে হলে আপনাকে শুধু এই ভাবে আঙুল দিয়ে এপাশ থেকে ওপাশে একটা টান দিতে হবে। “
জানুয়ারির প্রথম দিক নাগাদ প্রথম আইফোনের সব ভাইরাসজনিত সমস্যার সমাধান করা হলো, এবং উৎসাহী এ্যাপল ভক্তদের সামনে তা তুলে ধরলেন স্টিভ জবস সেই অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে । এ্যান্ডি এবং অন্য সবাই যারা এই প্রকল্পে কাজ করেছেন তারা তাদের সাফল্য উদযাপন করলেন।
” আমরা মঞ্চের কাছেই বসেছিলাম। সবারই কিছু না কিছু দায়িত্ব ছিল। আমরা ঠিক করেছিলাম বড় একটা স্কচ হুইস্কির বোতল নিয়ে আসবো, এবং সেই ডেমনস্ট্রেশনের প্রতিটি অংশে দেখানোর পরই এক ঢোক করে হুইস্কি খাবো। তাই করলাম। বলতেই হবে, অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে আমাদের বেশ নেশা হয়ে গিয়েছিল। “
২০০৭ সালের জুন মাসে উত্তর আমেরিকায় দোকান থেকে আইফোন বিক্রী শুরু হলো। এর আগে ছয় মাস ধরে চলেছিল প্রচারাভিযান। বিক্রি শুরু হতেই সাফল্য পাওয়া গেল তৎক্ষণাৎ।
আইফোনের দোকানের সামনে লোকে আগের রাত থেকে লাইন দিলো। দিনের বেলা দোকানের সামনের দৃশ্যটা হয়ে উঠলো অনেকটা সিনেমা হলের মতো। শুরু হলো স্মার্টফানের যুগ, লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনের প্রতিদিনের সঙ্গী হয়ে উঠলো এই ফোন।
এ্যান্ডি অবশ্য বলছেন, প্রযুক্তির ওপর আমাদের নির্ভরশীলতা সব সময়ই ভালো কিছু নয়।
” আমার মনে হয় আমরা কিছু একটা হারিয়েছি। মানুষের মধ্যেকার যে প্রত্যক্ষ মানবিক যোগাযোগ – তার কিছু দিক আমরা হারিয়ে ফেলছি। কিন্তু আমরা যা পাচ্ছি তা হলো নতুন ধরণের যোগাযোগ – যা আগে ছিল না্ । আমি দেখেছি একই পরিবারের সদস্যরা এক টেবিলের চারপাশে বসে আছে – কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছে না। আমি দেখেছি প্রেমিক-প্রেমিকা হয়তো একসাথে বসে আছে – কিন্তু দুজনেই যার যার মোবাইলের দিকে তাকিয়ে আছে হয়তো অন্য কারো সাথে তাদের যোগাযোগ হচ্ছে – কিন্তু তার পাশের জনের সাথে নয়। ব্যাপারটা হয়তো হাস্যকর -কিন্তু এটাই হয়তো এ প্রজন্মের কাছে স্বাভাবিক। হযতো তারা তাদের অভিজ্ঞতাই অন্রদের সাথে শেয়ার করছে, এবং সেটাও আবার শুধু কথা দিয়ে নয়, ইমোজি এবং আরো নানা কিছু দিয়ে। “
এ্যান্ডি গ্রিনিয়ন এখন এ্যাপল ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি এখন কাজ করছেন জেপি মরগ্যান চেজ ব্যাংকের ডিজাইন এন্ড টেকনোলজি ফেলো হিসেবে। কিন্তু .আইফোন প্রকল্পে কাজ করার কথা তিনিকোন দিনই ভুলবেন না। তার কথা , প্রযুক্তি যে কত তাড়াতাড়ি পরিবর্তন হয়, সে ব্যাপারে তিনি পুরোপুরি সচেতন।
” আইফোন যে প্রভাব ফেলেছে তা এমনকি এ্যান্ড্রয়েড ফোনের ওপরও পড়েছে। এখন যে সব স্মার্টফোন এসেছে বাজারে – তা রীতিমত একটা সুপারকম্পিউটার পকেটে নিয়ে ঘোরার মতো ব্যাপার । আমার মনে হয় এর পরের যুগের প্রযুক্তি হয়তো ব্যবহার করবে আমাদের চোখ ও কানকে। আপনি যদি আগামী পাঁচ বা দশবছরের কথা বলেন, তাহলে এমন হতে পারে যে আমরা আজকে যাকে স্মার্টফোন বলি – তার হয়তো অস্তিত্বই থাকবে না। “