ব্যাংক হিসাব খোলায় কড়াকড়ি আরোপে বিপাকে গ্রাহক

মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন প্রতিরোধে ব্যাংক হিসাব খোলায় কড়াকড়ি আরোপ করেছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। সম্প্রতি এটি আরও জোরদার করতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

ফলে নতুন ব্যাংক হিসাব খুলতে সর্বনিম্ন ৯ থেকে সর্বোচ্চ ৩০ ধরনের কাগজপত্র দাখিল করতে হয়। এসব কাগজপত্র না থাকলে ব্যাংক হিসাব খোলা সম্ভব হচ্ছে না। কোন হিসাবের কী ধরনের ফরম হবে সেগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সুনির্দিষ্ট করে দেয়া আছে। সে অনুযায়ী ব্যাংকগুলো নিজেদের নামে ফরম তৈরি করে নিয়েছে। এতে ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যের বাইরে আরও বাড়তি তথ্য সংযোজন করেছে। এতে নতুন হিসাব খুলতে গিয়ে বিপাকে পড়ছেন গ্রাহকরা।

জাহিদুল ইসলাম সাজিদ নামের একজন ব্যাংক গ্রাহক সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, একজন গ্রাহককে চেনা বা সে অপরাধ করলে তাকে ধরার জন্য জাতীয় পরিচয়পত্রই (এনআইডি) যথেষ্ট। কিন্তু ব্যাংকের হিসাব খুলতে গেলে এত বেশি কাগজপত্র দিতে হয় যে, বিষয়টি এখন বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

টেকনো ইনফো বিডি'র প্রিয় পাঠক: প্রযুক্তি, ব্যাংকিং ও চাকরির গুরুত্বপূর্ণ খবরের আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ এবং টেলিগ্রাম চ্যানেল এ লাইক দিয়ে আমাদের সাথেই থাকুন।

পুরনো হিসাব চালু রাখতে গেলেও এখন নতুন নিয়ম অনুযায়ী কাগজপত্র ব্যাংকগুলোকে দিতে হচ্ছে। এগুলো না দিতে পারলে হিসাব স্থগিত করে রাখা হচ্ছে। গ্রাহক কোনো লেনদেন করতে পারছে না। এছাড়া হিসাব খোলার সময় উল্লিখিত লেনদেনের সীমার চেয়ে বেশি লেনদেন হলে গ্রাহকদেরকে নানা প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে।

আল আমিন নামের একজন সাধারণ গ্রাহক সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ব্যাংকের মাধ্যমে কোথাও টাকা পাঠাতে গেলে বিরক্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে টাকার অঙ্ক বেশি হলেই বিড়ম্বনার শিকার হই। সে কারণে অনেকে ব্যাংকের মাধ্যমে না পাঠিয়ে বিকাশের মাধ্যমে টাকা পাঠায়।

সাধারণ সঞ্চয়ী হিসাব খোলার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দিষ্ট ফরম্যাটের এ আবেদনপত্র ব্যাংক কর্মকর্তার সামনে বসেই পূরণ করতে হয়। আবেদনপত্রের সঙ্গে গ্রাহকের পাসপোর্ট সাইজের চার কপি ছবি, পরিচয় প্রমাণের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট বা ড্রাইভিং লাইসেন্সের ফটোকপি দিতে হয়। গ্রাহক কোথাও চাকরি করলে দিতে হয় সেখানকার পরিচয়পত্র।

গ্রাহকের লেনদেনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে দিতে হয় বেতন-ভাতার সনদ, অন্য কোনো আয় থাকলে তার সনদও দিতে হয়। দাখিল করতে হয় কর দেয়ার সনদপত্র (টিআইএন), গ্রাহকের আবাসস্থল প্রমাণ করতে দিতে হয় বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল বা ওয়াসার বিলের কপি। কোনো স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান যেমন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বা সিটি কর্পোরেশন/পৌর সভার ওয়ার্ড কমিশনার কর্তৃক প্রদত্ত নাগরিকত্ব সনদও দিতে হয়।

অ্যাকাউন্টের মনোনীত উত্তরাধিকারী ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের (নমিনি) ছবি, তার পরিচয়পত্র, আবাসিক ঠিকানা, প্রমাণপত্র ইত্যাদি দাখিল করতে হয়। হিসাব খোলার দিন এসব কাগজপত্রের মূল কপি সঙ্গে আনতে হয় গ্রাহকদের। বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা এ সংক্রান্ত বিধি ২০১৭ সালের ১ এপ্রিল থেকে কার্যকর রয়েছে। এখন তা আরও কঠোরভাবে পরিপালনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

লিমিটেড কোম্পানির হিসাব খোলার ক্ষেত্রে দাখিল করতে হয় কোম্পানির মেমোরেন্ডাম ও আর্টিকেল অব অ্যাসোসিয়েশের সার্টিফায়েড কপি, পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির ক্ষেত্রে ব্যবসা শুরুর সার্টিফিকেট, হিসাব খোলা ও পরিচালনার জন্য সহ-অংশীদারের যথাযথ অনুমতি ও অ্যাকাউন্ট পরিচালনাকারীর প্রত্যয়নপত্র, নির্দিষ্ট ফরমে পরিচালকদের নাম ও ঠিকানা, স্বাক্ষরকারীদের ছবি, ট্রেড লাইসেন্সের কপি, হিসাব পরিচালনাকারীদের নামের তালিকা, তাদের পরিচয় নিশ্চিত করতে দিতে হয় প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, নিয়োগপত্র দাখিল করতে হয়, আয়কর প্রদানের টিআইএন এবং ভ্যাট প্রদানের ভিআইএন সনদপত্র দাখিল করতে হয়।

যেসব ব্যক্তি অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করবেন তাদের প্রত্যেকের একক অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য যে ৯ ধরনের প্রমাণপত্র দাখিল করতে হয়, সেটিও করতে হয়। অংশীদারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের হিসাব খোলার ক্ষেত্রে অংশীদারিত্বের চুক্তিপত্র, অংশীদারদের সভায় গৃহীত নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তগুলোর অনুলিপি, অংশীদারদের ঠিকানাসহ নামের তালিকা, ট্রেড লাইসেন্সের কপি, স্বাক্ষরকারীদের বা অংশীদারদের ছবি দাখিল করতে হয়।

হিসাব খোলা ও পরিচালনার জন্য সব অংশীদারের যথাযথ অনুমতি ও হিসাব পরিচালনাকারীর প্রত্যয়নপত্র দেখাতে হয়। প্রকৃত ব্যবসা ও অংশীদারিত্বের প্রমাণ হিসেবে সর্বশেষ পরিচালনা রিপোর্ট ও অডিট রিপোর্ট (যেখানে প্রযোজ্য) প্রদর্শন করতে হয়।

ব্যবসায় ও অংশীদারিত্বের প্রকৃতি সম্পর্কে তথ্য, যা হিসাব খোলার উদ্দেশ্যকে সমর্থন করে এমন প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দিতে হয়। ব্যক্তির পরিচয়ের যাবতীয় কাগজপত্র দাখিল করতে হয়। এসব কাগজপত্রের মূল কপি মিলিয়ে দেখেন ব্যাংক কর্মকর্তারা।

পেশার প্রমাণপত্র নিশ্চিত হয়ে মানি লন্ডারিংয়ের মান এবং আয়ের পরিমাণ নিশ্চিত হয়ে আয়ের মানি লন্ডারিং রেটিং নির্ধারণ করবে ব্যাংক। পেশা, আয় ও প্রতিষ্ঠান হিসেবে মানি লন্ডারিংয়ের ঝুঁকির রেটিং জারি করা সার্কুলারে নির্ধারণ করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

ব্যাংকসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংক কর্মকর্তার সামনে বসে আবেদনপত্রটি পূরণ করার বিষয়টি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। ব্যাংক কর্মকর্তাও এত সময় দিতে পারেন না। ফলে এটি কখনও ব্যাংক যেমন পালন করতে পারবে না, তেমনি পারবেন না গ্রাহকও। তাছাড়া যারা ভাড়া বাসায় থাকেন তাদের গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির বিল হয় মালিকের নামে। ফলে এগুলো জমা দিয়ে কোনো সুবিধা পাওয়া যাবে না।

সব হিসাবের ক্ষেত্রে ব্যাংকাররা একটি ফরম বাধ্যতামূলকভাবে পূরণ করান। সেটি হল তোমার গ্রাহককে জানো বা কেওয়াইসি। এখানে গ্রাহকের বিস্তারিত পরিচিতি উল্লেখ থাকে।

একজন ব্যাংকার সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমরাও বিরক্ত। কিন্তু কিছু করার নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার অনুযায়ী এটি করতে আমরা বাধ্য।
সূত্রঃ যুগান্তর

Leave a Reply

Back to top button