ডিজিটাল যুগের ব্যাংকিং
লেখক: মো. মোসলেহ উদ্দিন, ব্যাংকার ,কবি ও ফ্রিল্যান্স রাইটার।
মাইক্রোসফ্টের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে দু’দশক আগেও খুব একটা পরিচিত ছিলেন না। তিনি ১৯৫৫ তে জন্ম লাভ করে মাত্র পনের থেকে পঁচিশ বছর বয়স তথা ১৯৭০ ও ১৯৮০ এর দশকে মাঝেই মাইক্রো কম্পিউটার বিপ্লবের অন্যতম সেরা উদ্যোক্তা এবং পথিকৃৎ হিসেবে বিশ্বে খ্যাতি লাভ করেন।
আর বাংলাদেশ (তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তান) এ কম্পিউটারের ব্যবহার ষাটের দশকে শুরু হয়। তবে নব্বই দশকের মধ্যভাগ থেকে এ দেশে তথ্য প্রযুক্তি বিস্তৃতি লাভ করতে শুরু করে। আর তখন থেকেই বিল গেট্সও আস্তে আস্তে পরিচিত হতে থাকেন। আর এখন তো বিল ছাড়া আমাদের চলেই না!
নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে দেশে কম্পিউটারের ব্যক্তিগত ও বাণিজ্যিক টাইপিং কাজটারই প্রধান ছিল। এ সময়টায় ছিল শত শত বছরের ঐতিহ্যের টাইপ মেশিনের পাশাপাশি কম্পিউটারের জায়গা করে নেয়ার সময়। এরপর অবিলম্বে টাইপ মেশিনের ব্যবহার উপযোগিতা কমতে কমতে শূণ্যের কোটায় চলে আসে। এভাবেই একসময়ের অতিপ্রয়োজনীয় টাইপ মেশিন নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ টাইপিস্টগণও হারিয়ে যান দৃশ্যপট থেকে।
টেকনো ইনফো বিডি'র প্রিয় পাঠক: প্রযুক্তি, ব্যাংকিং ও চাকরির গুরুত্বপূর্ণ খবরের আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ এবং টেলিগ্রাম চ্যানেল এ লাইক দিয়ে আমাদের সাথেই থাকুন। |
তবে যারা সময়ের চাহিদা বুঝে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে কম্পিউটার ট্রেনিং নিয়ে একই কাজা কম্পিউটারে শুরু করেন তার ভালোভাবে ঘুরে দাঁড়ান। বলতে গেলে তাদের কাজ এবং আয় দু’টোই আগের চেয়ে বেড়ে যায়। এসময় নতুন প্রজন্মের অনেকেই প্রশিক্ষণ নিয়ে এ পেশায় ঝুঁকে পড়েন।
এরপর থেকে কালক্রমে এর ব্যবহার সর্বব্যাপী হয়ে উঠে। ইতিমধ্যে ছাপার কাজের ট্র্যাডিশনাল লেটার প্রিন্ট মেশিনের পাশাপাশি স্থান পেতে থাকে সরাসরি কম্পিউটারে লেখা প্রিন্ট সাপোর্টের ছোট আকারের মেশিন। ছাপার মান ও কর্মক্ষমতা গুণে অচীরেই এগুলো জনপ্রিয় হতে শুরু করে। সঙ্গত কারণেই পুরাতন ছাপা মেশিনগুলোও অকোজো এবং অপ্রয়োজন বিবেচনায় পরিত্যক্ত হয়ে যায়।
একই সময়ে এই কম্পিউটারই ব্যাংকিং ক্ষেত্রেও আনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। শত শত বছরের ঐতিহ্যের ব্যাংকিং লেজার (খতিয়ান বহিঃ) ছেড়ে গ্রাহক তথ্য এবং একাউন্টসের জন্য কম্পিউটারই হয়ে পড়ে ব্যাংক ব্যবস্থার অপরিহার্য অনুষঙ্গ। সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে পরিবর্তন ও উত্তরণের হাওয়া।
আমাদের দেশের ব্যাংকিং মান্ধাতার আমলের বড় বড় লেজার বহি ছেড়ে অতি সীমিত পরিসরে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির পথে যাত্রা শুরু করে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি। অথচ বাকি বিশ্বে তখন বিপ্লব প্রায় শেষ! সেসময়ই ১৯৯৪ সালে বিল গেটস বলেছিলেন, Banking is necessary, Banks are not. অর্থাৎ ব্যাকিংয়ের প্রয়োজন আছে, তবে ব্যাংকের প্রয়োজন নেই।
তখন সাধারণ মানুষ তো বটেই এদেশের ব্যাংকাররাও জানতো না তার সেই বিখ্যাত উক্তির কথা। আর না জেনেও ভালই হয়েছে। তা না হলে তখনকার প্রেক্ষাপটে দেশের মানুষ বিলকে পাগল আখ্যা দিয়েই তবে ছাড়তো। আর এখন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশ ও উন্নতির ফলে ব্যাংকিং ক্ষেত্রে ডিজিটাল রেভ্যুলেশন সাধিত হওয়ায় এটিই এখন অপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে ব্যাংকিং খাতে।
মানব সভ্যতার ইতিহাস, অর্থনৈতিক উন্নতি এবং অগ্রগতির সাথে ব্যাংক এবং ব্যাংকিং এর উন্নয়ন এবং অগ্র্রগতির ইতিহাস ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। সেই প্রস্তর যুগ থেকে ডিজিটাল যুগ সবসময়ই কোনো না কোনো ফর্মে মানুষ পারস্পরিক আর্থিক প্রয়োজনগুলো মেটাতো। সেই চাহিদার আলোকে ব্যক্তি থেকে প্রতিষ্ঠান, ঘরে থেকে বাইরে নানা ধাপ পেরিয়ে আজকের দিনের প্রচলিত এবং প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাংকিং কাঠামো। এখন যা আমরা দেখি তা পদ্ধতিগতভাবে ম্যানুয়েল থেকে অটোমেশন ফর্ম।
প্রযুক্তির নিত্যনতুন উৎকর্ষ, বাজার চাহিদা এবং আরো অনেক বাস্তব কারণে দেশের সরকারি-বেসরকারি সকল ব্যাংক ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবায় অভ্যস্থ হয়ে পড়েছে। ডিজিটাল প্রযুক্তির কল্যাণে ইতিমধ্যে প্রতিনিয়ত যোগ হচ্ছে ব্যাংকিং সেবার নানা বৈচিত্র। এটিএম-ডেবিট কার্ডের পাশাপাশি ক্রেডিট কার্ড এবং ইন্টারনেট ব্যাংকিং সেবাও যোগ হয় একই সময়ে। এরপর মোবাইল ফাইনান্সিয়াল সার্ভিস আনে আরো ব্যাপক এবং বৈপ্লবিক পরিবর্তন। ব্যাংকিং এবার হাতে হাতে।
প্রযুক্তিনির্ভর ব্যাংকিং ব্যবস্থার এই আপডেট ভারসনই হলো ফাইনানন্সিয়াল টেকনোলজি বা সংক্ষেপে ফিনটেক (FINTECH)। ব্যাংকে না গিয়ে স্ব স্ব অবস্থানে থেকে ব্যাংকিং সেবার পুরোটা নেবার স্বাধীনতাই এখন গ্রাহকের। এন্ড্রয়েড মোবাইল, ল্যাপটপ এবং কম্পিউটার ডিভাইসের মতো ডিজিটাল ইন্সট্রুমেন্টের মাধ্যমে নিমিষেই সেরে ফেলা যায় এখন ব্যাংকিং। স্থান কালের বাধ্যবাধকতা নেই, লাইনে দাঁড়াবার ঝাঁক্কি
নেই এবং টাকা বহনের ঝুঁকিও নেই এখানে। কেনাকাটা লেনদেনের জন্য এসেছে প্লাস্টিক মানি খ্যাত ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড এবং প্রিপেইড কার্ড ইত্যাদি। যা দিয়ে বুথ থেকে নগদ টাকা উত্তোলনের পাশা পাশি সাধারণ কেনাকাটা, ইয়ার টিকেটিং, ই-কমার্সসহ সব রকমের লেনদেন করা যায় দেশ এবং দেশের বাইরে।
তবে দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার এই পরিবর্তনে প্রথমে যারা নেতৃত্ব দেন তাদের অনেকে ব্যাংকিংই শুরুই করেন শতভাগ অটোমেশন দিয়ে। এক্ষেত্রে সবার আগে যে ব্যাংকির নাম নিতে হয় সেটি হলো ডাচ্ বাংলা ব্যাংক লিমিটেড। ২০০০ সালে স্থাপিত ব্যাংকটি শতভাগ কম্পিউটারাইজ্ড কোর ব্যাংকিং সেবার পাশাপাশি বিকল্প ব্যাংকিং হিসেবে এ ব্যাংকটিই দেশে প্রথম এটিএম বুথ স্থাপন করে।
বাংলাদেশে সর্বব্যাপী ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবার সেবার জগতে প্রবেশের এটি প্রথম উদ্যোগ হলেও অনতিবিলম্বে নতুন প্রজন্মের অনেক ব্যাংকও প্রযুক্তিনির্ভর সেবা শুরু করে।
তবে চ্যালেঞ্জের কারণ হয়ে দাঁড়ায় ম্যানুয়েল যুগে শুরু হওয়া ব্যাংকগুলো মধ্যে ব্যবসায়িক ভলিওমে বড় হয়ে উঠা ব্যাংকগুলোর জন্য। এ প্রসঙ্গে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের কথা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার প্রথম সুদমুক্ত ব্যাংক পরবর্তিতে প্রাইভেট সেক্টর ব্যাংকিংয়ে দেশের সর্ববৃহৎ ব্যাংকটির জন্য চ্যালেঞ্জ ছিল আরো বেশি। ফলে লেজার থেকে টোটাল অটোমেশনে যেতে বেশ কিছুটা সময় লেগেছে।
ভেন্ডর সফটওয়্যার দিয়ে অটোমেশনের যুগে প্রবেশ করলেও অনতিবিলম্বে ইসলামী ব্যাংকিং উপযোগী সফটওয়্যার উদ্ভাবনের দিকে নজর দেয় ব্যাংকটি। এক্ষেত্রে তাদের সফলতাও ঈর্ষনীয়। ব্যাংকের নিজস্ব জনশক্তি কর্তৃক উদ্ভাবিত এবং উন্নীত দেশের একমাত্র হোম প্রোগামিং ব্যাংকিং সফটওয়্যার ”ইলেক্ট্রনিক ইন্ট্রিগেটেড ব্যাংকিং সিস্টেম” (ইআইবিএস) সব অসম্ভবকেই সম্ভব করে দিয়েছে।
মেশিন থেকে শুধু টাকা উত্তোলন নয়, জমায় দেয়া যায় এমন মেশিন (CRM) ও ব্যাপকভাবে স্থাপন করে ইসলামী ব্যাংক। ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ডসহ কার্ড ব্যাংকিয়ের সব, ইন্টারনেট ব্যাংকিং, সেলফিন, এসএমএস, ক্যাশ বাই কোড, এমক্যাশসহ ফাইনান্সিয়াল টেকনোলজি বা ফিনটেক সার্ভিসের নিত্যনতুন এবং শতভাগ নিরাপদ সেবা দিয়ে গ্রাহকমন আকৃষ্ট হয়।
আরও দেখুন: চতুর্থ শিল্প বিপ্লব: ব্যাংক খাতের চ্যালেঞ্জ ও প্রস্তুতি
ফলশ্রুতিতে বিরক্তিকর ভীড়বাজারের বদনাম থেকেও মুক্ত হয়। এখন ব্যাংকটি ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের নতুন ভাবমূর্তি গড়তে অনেকটাই সক্ষম হয়েছে।
২ Comments