রেমিট্যান্সে জোয়ার এনেছে এজেন্ট ব্যাংকিং: শীর্ষে ইসলামী ব্যাংক

দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দিতে ২০১৪ সালে চালু হয় এজেন্ট ব্যাংকিং। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে লাইসেন্স নিয়ে এরই মধ্যে ২৮টি ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের বাজার দখলের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। দ্রুত গতিতে সম্প্রসারিত হওয়া এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের বিস্তৃতি, সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন দ্বিতীয় পর্ব
দেশের রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধিতে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছেন প্রবাসীরা। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসেই আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪৩ শতাংশ বেশি রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন তারা। রেমিট্যান্স প্রবাহের এমন জোয়ারে বড় ভূমিকা রাখছে এজেন্ট ব্যাংকিং। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর—এ তিন মাসেই এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ১১ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকার রেমিট্যান্স এসেছে দেশে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে মোট রেমিট্যান্স এসেছিল ১৫ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকা। আর চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নয় মাসেই এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ২২ হাজার ৮০১ কোটি টাকার রেমিট্যান্স এসেছে। এক বছরের ব্যবধানে এজেন্ট ব্যাংকিং সেবায় রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২২১ শতাংশ।
টেকনো ইনফো বিডি'র প্রিয় পাঠক: প্রযুক্তি, ব্যাংকিং ও চাকরির গুরুত্বপূর্ণ খবরের আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ টেকনো ইনফো বিডি এবং টেলিগ্রাম চ্যানেল এ লাইক দিয়ে আমাদের সাথেই থাকুন। |
ব্যাংকাররা বলছেন, আগে রেমিট্যান্সের অর্থ গ্রহণের জন্য গ্রাহকদের ব্যাংকের শাখায় আসতে হতো। দূরত্ব, শারীরিক ও আর্থিক ঝুঁকির কারণে অনেক প্রবাসী পরিবারই ব্যাংকের শাখায় এসে টাকা নিতে অস্বস্তিতে থাকত। এর সুযোগই নিত হুন্ডি কারবারিরা। তাদের নিয়োগ দেয়া লোকেরা অবৈধ পথে আসা রেমিট্যান্সের অর্থ প্রবাসী পরিবারে পৌঁছে দিত। এখন বাড়ির পাশের বাজারে ব্যাংকগুলোর এজেন্ট পৌঁছে গেছে। ফলে নিরাপদ মাধ্যমে প্রবাসী পরিবারের সদস্যরা রেমিট্যান্সের অর্থ উত্তোলন করতে পারছেন। অনেক ক্ষেত্রে এজেন্টরাই উপকারভোগীদের ঘরে রেমিট্যান্সের অর্থ পৌঁছে দিচ্ছেন। এতে প্রবাসীদের কাছে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের জনপ্রিয়তা বাড়ছে, যা রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখছে। সেই সঙ্গে রেমিট্যান্সকে কেন্দ্র করে হুন্ডির তত্পরতা প্রায় বন্ধ হয়ে এসেছে।
ফেনী সদরের সুন্দরপুর গ্রামের অশীতিপর লিয়াকত আলী। চার সন্তানের জনক লিয়াকতের তিন ছেলেই থাকেন সৌদি আরবে। প্রতি মাসেই তার সন্তানরা পরিবারের জন্য রেমিট্যান্সের অর্থ পাঠান। ইসলামী ব্যাংকের ফেনী শাখার মাধ্যমে আসা রেমিট্যান্সের অর্থ আনতে তাকে যেতে হতো শহরে। অসুস্থ শরীর নিয়ে টাকা তুলতে যাওয়া ছিল তার জন্য বিড়ম্বনার। এখন সুন্দরপুর বাজারেই ইসলামী ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট চালু হয়েছে। ফলে বাড়ির পাশের বাজার থেকেই রেমিট্যান্সের অর্থ উত্তোলন করতে পারছেন লিয়াকত আলী। এ নিয়ে বণিক বার্তার কাছে নিজের তৃপ্তির কথা জানিয়েছেন তিনি।
এজেন্টদের মাধ্যমে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ স্বজনদের কাছে পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করছে ২৪টি ব্যাংক। তবে এ চেষ্টায় সবচেয়ে বেশি সফলতা পেয়েছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। দেশে এখন পর্যন্ত এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে যে রেমিট্যান্স এসেছে তার ৪৫ শতাংশই এসেছে ব্যাংকটির মাধ্যমে। এক্ষেত্রে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে রেমিট্যান্স আহরণে শীর্ষ পাঁচে থাকা অন্য ব্যাংকগুলো হলো ব্যাংক এশিয়া, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক ও অগ্রণী ব্যাংক।
এজেন্টরা ইসলামী ব্যাংকের রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখছেন বলে জানান ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মাহবুব উল আলম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, প্রবাসী বাংলাদেশীদের কাছে সবচেয়ে বিশ্বস্ত নাম হলো ইসলামী ব্যাংক। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই আমাদের ব্যাংক প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ আমানতদারিতার সঙ্গে তাদের স্বজনদের বুঝিয়ে দেয়ার দায়িত্ব পালন করছে। মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ দেশের প্রধান শ্রমবাজারগুলোতে অবস্থানকারী বাংলাদেশীদের অর্ধেকের বেশি হিসাব ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে শাখা না থাকায় অতীতে আমাদের গ্রাহকদের একটি অংশ অন্য ব্যাংক বা হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠাতেন। এজেন্ট ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইসলামী ব্যাংকের সেবা ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে আমাদের গ্রাহকরা এজেন্টদের মাধ্যমে আগের চেয়ে বেশি অর্থ পাঠাচ্ছেন। প্রবাসীদের স্বজনরা বাড়ির পাশের বাজার থেকে টাকা তুলতে পারছেন। ভবিষ্যতে আমাদের ব্যাংকের রেমিট্যান্স প্রবাহ আরো বাড়বে।
দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীকে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির আওতায় নিয়ে আসার লক্ষ্য নিয়ে ২০১৪ সালে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের যাত্রা। কার্যক্রম শুরুর ছয় বছরের মধ্যেই গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছে সেবাটি। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ২৮টি ব্যাংক লাইসেন্স নিয়েছে। ২৪টি ব্যাংক এরই মধ্যে সেবাটি চালু করেছে। এ ব্যাংকগুলো নিয়োগ দিয়েছে ১০ হাজার ১৬৩ এজেন্ট। নিয়োগপ্রাপ্ত এজেন্টরা ১৪ হাজার ১৬টি আউটলেট চালু করেছেন। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এজেন্টদের মাধ্যমে ৩৮ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকার রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় দেশে এসেছে। এজেন্টদের মাধ্যমে আসা রেমিট্যান্সের ৯০ শতাংশই গ্রামাঞ্চলের আউটলেটগুলোর।
চলতি বছরের শুরু থেকে বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস আঘাত হানা শুরু করলেও বাংলাদেশে প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়ে ৮ মার্চ। এরপর ২৬ মার্চ থেকে দেশজুড়ে অঘোষিত লকডাউন জারি করা হয়। এতে যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। এ অবস্থায় ব্যাংকগুলোর নিয়োগ দেয়া এজেন্টরা প্রবাসী পরিবারের বন্ধু হয়ে উঠেছেন।
২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এজেন্টদের মাধ্যমে মোট রেমিট্যান্স এসেছিল ১৫ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকা। আর বিশ্বব্যাপী মহামারী আঘাত হানার পর মাত্র নয় মাসে এজেন্টদের মাধ্যমে ২২ হাজার ৮০১ কোটি টাকার রেমিট্যান্স এসেছে। এর মধ্যে জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত এসেছে ৪ হাজার ১ কোটি টাকা। দেশে করোনাভাইরাস ভয়াবহ মাত্রায় ছড়িয়ে পড়ার পর এজেন্টদের মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রবাহ দ্বিগুণ হয়েছে। এপ্রিল থেকে জুন—এ তিন মাসে এজেন্টদের মাধ্যমে ৭ হাজার ১১৫ কোটি টাকার রেমিট্যান্স আসে। আর জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর—এ তিন মাসে এজেন্টদের মাধ্যমে এসেছে ১১ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকার রেমিট্যান্স।
এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের বিস্তার অবৈধ হুন্ডি তৎপরতা বন্ধে কার্যকর ভূমিকা রাখছে বলে মনে করেন ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আরফান আলী। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, আমাদের হাত ধরেই দেশে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের যাত্রা। আমরা চেষ্টা করেছি দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে এজেন্ট ব্যাংকিং পৌঁছে দেয়ার। এ প্রচেষ্টায় আমরা সফলও হয়েছি। আমাদের এজেন্টরা প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ তাদের স্বজনদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। এতে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে হুন্ডি তত্পরতা কমে এসেছে। এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা যত বেশি বিস্তৃত ও সমৃদ্ধ হবে, হুন্ডির তৎপরতা তত বেশি কমবে। সোর্স: বণিক বার্তা।